মিরসরাই ট্র্যাজেডি দিবস: সময় থেমে যায় ১১ জুলাইয়ে

চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে ২০১১ সালের ১১ জুলাই, সময় যেন থমকে গিয়েছিল।  ফুটবল খেলা শেষে বাড়ি ফেরার পথে সৈদালীতে ডোবার পানিতে উল্টে পড়ে এক ট্রাক খুদে শিক্ষার্থী।  মুহূর্তেই থেমে যায় ৪৫টি তরতাজা প্রাণের জীবনপ্রবাহ।  মিরসরাইয়ের মানুষের কাছে এ দিনটি শুধু একটি তারিখ নয়—এটি এক অসহনীয় বেদনার নাম, একটি বিয়োগান্তক অধ্যায়, যা আজও দগদগে স্মৃতি হয়ে বুকে বয়ে বেড়ায় পরিবারগুলো।

প্রিয়জন হারানো স্বজনদের কাছে ১১ জুলাই মানেই বুকফাটা হাহাকার। স্মৃতিতে এখন শুধুই ছবির ফ্রেম—সেখানে হাসছে শাকিব, নয়ন, উজ্জল, টিটু, ইফতেখার, সাজু, কাজল, জুয়েল, মোবারক, ধ্রুবরা, সুজনরা। কিন্তু বাস্তবে তারা নেই। নেই তাদের হাসি, নেই প্রাণ।

নিহত শিক্ষার্থী আবু সুফিয়ান সুজনের বাবা মোহাম্মদ রিদওয়ান বলেন, “সন্তানকে হারিয়ে ১৩ বছর পার হয়ে গেল। আমার সন্তানের সমবয়সীরা আজ বাবা মায়ের স্বপ্ন পূরণ করে পৌঁছেছে উন্নতির শিখরে। অথচ আমার সন্তান ঘুমিয়ে আছে নিরবে কবরে। আমার একটিমাত্র ছেলে ছিলো তাকে হারিয়ে যেন আজ একা হয়ে গেছি।

নিহত শিক্ষার্থী সুজনের বন্ধু ফরিদুল ইসলাম বলেন, দুর্ঘটনার সময় সুজন নবম শ্রেণীতে পড়তো। খুবই ভদ্র ও মেধাবী একজন ছাত্র ছিলো। পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলা খুব পছন্দ করতো। দুর্ঘটনার দিন আমার সামনেই ওনি স্কুলে এসেই হেডস্যার থেকে খেলা দেখার জন্য ছুটি নিয়ে ছিলেন। তার মৃত্যুতে আমরা সকলেই খুব ব্যথিত হয়েছি। ওনি বয়সে আমার একটু বড় হলেও আমরা বন্ধুর মত চলাফেরা করতাম।

#

দিবসটি উপলক্ষে প্রতিবছর আবুতোরাব বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে আয়োজন করা হয় কোরআন খতম, স্মৃতিস্তম্ভ ‘আবেগ’ ও দুর্ঘটনাস্থলের ‘অন্তিম’-এ পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ, শোকসভা ও দোয়া মাহফিল। কিন্তু নিহতদের স্বজনদের অভিযোগ—এই আয়োজন কেবল দিনপঞ্জির আনুষ্ঠানিকতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেউ আর সারা বছর তাদের খোঁজ নেয় না।

এদিনটিকে কেন্দ্র করে সীমিত পরিসরে কিছু আয়োজন দেখা গেলেও, রাষ্ট্রীয়ভাবে দিবসটি স্মরণ করার কোনো উদ্যোগ নেই। নিহতদের পরিবারগুলো চান, মিরসরাই ট্র্যাজেডিকে জাতীয়ভাবে স্মরণ করা হোক—শুধু আনুষ্ঠানিকতার জন্য নয়, ভবিষ্যতের জন্য শিক্ষা হিসেবে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ট্র্যাজেডির পর দায়ী পিকআপ চালক মফিজুর রহমানকে আটক করে আদালতে পাঠানো হয়। দীর্ঘ পাঁচ বছর কারাভোগের পর ২০১৬ সালের ২৮ জুলাই তিনি মুক্তি পান। এরপর আত্মগোপনে ছিলেন। পরবর্তীতে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে ২০২৩ সালের ২৮ এপ্রিল মারা যান নিজ বাড়িতে।

কি ঘটে ছিলো সেদিন?

২০১১ সালের ১১ জুলাই, বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্টে খেলা শেষে মিরসরাই স্টেডিয়াম থেকে ফেরার পথে শিক্ষার্থীদের বহনকারী মিনি ট্রাক সৈদালী এলাকায় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পড়ে একটি ডোবায়। ট্রাকটিতে শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও ফুটবলপ্রেমীদের উপচে পড়া ভিড়ে ঠাসা ছিলো। মুহূর্তেই ডুবে যায় ট্রাকটি। কোনোভাবেই বাঁচানো যায়নি নিচে আটকে পড়া প্রাণগুলোকে। নিহতদের মধ্যে ছিলো- আবুতোরাব উচ্চ বিদ্যালয়ের ৩৪ জন, আবুতোরাব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৪ জন, আবুতোরাব ফাজিল মাদ্রাসার ২ জন, প্রফেসর কামাল উদ্দিন কলেজের ২ জন, ১ জন অভিভাবক ও ২ জন খেলাপ্রেমি যুবক। গোটা উপজেলা সেদিন শোকে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল।

এই ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখতে স্কুলের প্রবেশমুখে নির্মাণ করা হয় স্মৃতিস্তম্ভ ‘আবেগ’। দুর্ঘটনাস্থলে নির্মিত হয় ‘অন্তিম’ নামের আরেকটি স্তম্ভ।

এ সম্পর্কিত আরও খবর